সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যঃ নিজের যত্ন নিন এবং অন্যকেও সাহায্য করুন

আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। পুরো বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে দিবসটি। শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা অনেকটাই সচেতন হলেও মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতে পারেনি আজও। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা কথা বলব মানসিক স্বাস্থ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে।

সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য: অধিক বিনিয়োগ—অবাধ সুযোগ’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে বেসরকারি, সরকারি সহ নানা ভাবেই পালিত হচ্ছে এই দিনটি। মানসিক স্বাস্থ্য দিবস বিষয়ে বক্তব্য রাখতে যেয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তির জন্য শুধুমাত্র চিকিৎসা নয় বরং তার প্রতি পরিবারকেও অনেক দায়িত্বশীলতার পাশাপাশি সহানুভূতিও প্রকাশ করতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি—আসুন তাহলে জেনে নেই মানসিক স্বাস্থ্যের আদ্যোপান্ত! 

মানসিক স্বাস্থ্যে সেবায় আমাদের তৎপরতা আরো বাড়ানো উচিত। এর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমনঃ মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করা, উন্নত মানসিক স্বাস্থ্য সেবা এবং উন্নত চিকিৎসা প্রদান, সব ধরনের মানসিক রোগের বিদ্যমান চিকিৎসা উন্নত করার জন্য গবেষণাগার তৈরি করে গবেষনা ববৃদ্ধি করা যেতে পারে।  ২০১৯ সালে “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা” মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য স্পেশাল  ইনিশিয়েটিভ ফর মেন্টাল হেলথ [২০১৯-২০২৩] এর মাধ্যমে  ১২টি অগ্রাধিকার ভুক্ত দেশে সেরা মান এবং সাশ্রয়ী চিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে  ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ চালু করেছে। 

চলতি বছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ১০ই অক্টোবর এমন একটি সময়ে উপস্থিত হয়েছে ঠিক যখন  মহামারি কোভিড-১৯ ভাইরাস বিশ্বব্যাপী দৈনন্দিন জীবনকে ব্যপক হারে পরিবর্তন করে দিয়েছে। প্রত্যেকটি শ্রেণী এবং পেশার মানুষ এই কোভিড-১৯ নামক মহামারীর কারণে আতংকিত। যখন চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা ভয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরতে পারেনা যদি তার সাথে কোভিড-১৯ তার বাসায়ও চলে আসে, শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে পারেনা, কর্মজীবী মানুষেরা তাদের কর্মস্থলে যেতে পারেনা তখন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটবেই। যারা আগে থেকেই মানসিক স্বাস্থ্যে অবনতিতে ভুগছিলো তারা এখন আরো বেশি সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এমনকি প্রিয়জনকে হারানোর পর শোক প্রকাশের অবস্থায়ও তারা নেই। 

মহামারীর ফলে অর্থনৈতিক অবস্থারও ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। এ অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি করতে হবে। নাহলে ব্যাপক হারে সামাজিক অবক্ষয় তৈরি হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এবছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্যে দিবসকে কেন্দ্র করে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে এবং এর প্রচারণা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

মানসিক স্বাস্থ্য কি?

আপনি মানসিক ভাবে সুস্থ বলে এই নয় যে আপনার কোন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নেই। আপনার যদি মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো হয়ে থাকে তাহলে আপনি আপনার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং কর্মস্থলের সঙ্গীদের মানসিক স্বাস্থ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করুন। কিছু মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যকে মানসিক সুস্থতা বলে অভিহিত করে থাকে যা শারীরিক সুস্থতার মতই গুরুত্বপূর্ণ।

একটি শিশুর জন্মের পর থেকে শুরু করে এমনকি প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েও জীবনের সবগুলো লক্ষ্য ও প্রতিটি পদে পদে মানসিক ভাবে সুস্থতার প্রয়োজন অপরিসীম। একজন মানুষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এমনকি শারীরিক ভাবেও সুস্থ থাকার জন্য মানসিক ভাবে সুস্থ থাকার প্রয়োজন। এই বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ১৫-২৯ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে ডিপ্রেশন জনিত কারণে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি দেখা যায়।  

সচেতনতার অভাবে অনেকেরই জানা নেই যে আমাদের দেশে মানসিক সমস্যা খুব অল্প খরচেই চিকিৎসা করা সম্ভব। মোহাম্মদপুর কলেজ গেট সংলগ্ন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটে মাত্র ২০ টাকায় টিকেট কেটেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা আপনি চাইলেই নিজের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে নিতে পারেন। এমনকি সেখানের বেশীরভাগ ওষুধ আপনি একদমই ফ্রিতে পেয়ে যাবেন। 

মানসিক স্বাস্থ্য জনিত সমস্যাগুলো কি কি? 

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো বিভিন্ন মেয়াদে স্থায়ী হয়ে থাকে। আমাদের দৈনন্দিন উদ্বেগগুলো থেকে শুরু করে দীর্ঘদিনের কোন দুশ্চিন্তা এ সবকিছুই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার অন্তর্ভুক্ত।  যারা মানসিক স্বাস্থ্য জনিত জটিলতায় ভুগে থাকেন এবং যদি তাদেরকে পর্যাপ্ত সেবা ও সহযোগিতা করা হয় তাহলে তাদের বেশিরভাগই খুব দ্রুত সেরা উঠেন এবং নতুন করে বাঁচতে শিখেন।

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোকে ধরণ অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত এবং শ্রেণীভাগ করা হয়। এতে চিকিৎসকেরা শ্রেণীভাগ অনুযায়ী সহজে তাদের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে পারেন। কিছু কিছু রোগ নির্ণয় পদ্ধতি বিতর্কিত এবং মানসিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে যার ফলে পরবর্তীতে তাদের জীবনযাত্রায় এর প্রভাব পড়ে থাকে। কিন্তু তারপরেও লক্ষণ অনুযায়ী শ্রেণীভাগ করে রোগ নির্ণয়ের এ পদ্ধতিগুলো চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যাবহার করতে হয় । 

বেশিরভাগ মানসিক স্বাস্থ্যে সমস্যাগুলোকে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী  “নিউরোটিক” অথবা “সাইকোটিক” ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

স্বাভাবিক মানসিক স্বাস্থ্যের তুলনায় অধিক অবনতির লক্ষণ, যেমন বিষণ্ণতা, উদ্বেগ বা আতংক এগুলো নিউরোটিক শ্রেনীর ভাগের অন্তর্ভূক্ত। 

নিউরোজ” নামে পরিচিত শ্রেনীভাগটিকে বর্তমানে সাধারণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বলা হয়ে থাকে। 

সাইকোটিক শ্রেণীভাগের লক্ষণগুলো তুলনামূলক ভাবে কম দেখা যায়। এতে হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে ফলে বাস্তব এবং অবাস্তবের মিশ্রণে ভ্রম তৈরি হয়, এটা শুধু রোগীর ক্ষেত্রেই অনুভূত হয় অন্য কোন ব্যক্তি এটা অনুভব করতে পারেনা। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো আপনার চিন্তা, আচরণ এবং অনুভূতিগুলোকে প্রভাবিত করে থাকে যা একজন চিকিৎসকই কেবল নির্ণয় করতে পারবেন। 

একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১জন ব্যক্তি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগে থাকেন। উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতা এর মধ্যে একটি অন্যতম সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা যাতে প্রতি ১০ জনের মধ্যেই ১ জন আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এগুলো অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় এর প্রভাব পড়তে থাকে। 

মানসিক সু-স্বাস্থ্য 

মানসিক সুস্বাস্থ্য একজন ব্যক্তির কার্যকলাপ এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ আচার আচরণের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যেমন-

  • কোন কিছু শেখা বা আয়ত্ত করার ক্ষমতা

  • ইতিবাচক এবং নেতিবাচক অনুভূতি সহ বিভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করা 

  • পরিবর্তন এবং অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করতে পারা এবং পরিচালনা করতে পারা 

  • পরিবার, বন্ধু বা আত্মীয় সহ অন্যান্য মানুষের সাথে মেলামেশা করতে পারা এবং সুসম্পর্ক তৈরি করা ও তা বজায় রাখা

কিভাবে আপনি মানসিক সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী হবেন এবং এর যত্ন নিবেন? 

আপনার জীবন এবং নিজের যত্ন নেওয়া আপনার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।  মানসিক সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার জন্য ১০টি টিপস আপনাদের বলবো যা আপনাদের কাজে লাগবে। এর জন্য আপনার জীবনযাত্রায় হয়ত কিছুটা পরিবর্তন নিয়ে আসতে হতে পারে। তবে এর জন্য প্রচুর সময় কিংবা টাকা খরচ করতে হবেনা। যে কেউ চাইলেই আমাদের এই টিপসগুলো খুব সহজেই মেনে চলতে পারবেন। 

১) অন্যদের কাছে আপনার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করুন। তাদের সাথে আপনার অনুভূতিগুলো ভাগাভাগি করে নিন ও তাদের সাথে মেশার চেষ্টা করুন।

২) নিয়মিত ব্যায়াম করুন। নিয়মিত ব্যায়াম আপনার শরীর এবং মস্তিষ্ক দুটোকেই সুস্থ রাখতে সহায়ক। নিয়মিত ব্যায়াম করলে আপনার কোন কাজে মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং ঘুম ভালো হওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরী প্রভাব রাখতে পারবে। 

৩) নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। আপনার শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মত মস্তিষ্কেরও বিভিন্ন ধরনের পুষ্টির প্রয়োজন হয়। আপনি বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবারের মাধ্যমে এই চাহিদা পূরণ করতে পারবেন। 

৪) অ্যালকোহল সেবন থেকে বিরত থাকুন। আমরা অনেকে মনে করে থাকি যে অ্যালকোহল আমাদের মানসিক ভাবে স্থিতিশীল হতে সাহায্য করে তবে সত্যিকার অর্থে এটি মস্তিষ্কের উপর বিরূপ প্রভাব তৈরি করে। 

৫) আপনার পরিবার, বন্ধু, আত্মীয় সবার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। তাদের সাথে আড্ডা দিন কথা বলুন এতে আপনার মন ভালো থাকবে যা মানসিক সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। 

৬) আপনি কোন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকলে আপনার আশে পাশের লোকজন যেমন পরিবার ও বন্ধুদের সাথে বিষয়টি শেয়ার করুন। তাদের কাছে সাহায্য চান। তারা কি ভাববে এই উদ্বেগে বিষয়টি চেপে রাখবেন না। 

৭) কর্মব্যাস্তময় জীবন থেকে কিছুটা বিরতি নিন। এতে আপনার মস্তিষ্ক কিছুটা বিশ্রাম পাবে। সারাদিনে নিজের জন্য একটু সময় বের করে নিন এবং সে সময়টা উপভোগ করুন।

৮) আপনার ভালো লাগে এমন কাজগুলো করুন। এতে সে সময়টা আপনার কাছে উপভোগ্য হবে। 

৯) আপনি যেমনই হন না কেন নিজেকে জোর করে পরিবর্তন করা দরকার নেই। সবাই নিজ নিজ বৈশেষ্ট্যের অধিকারী। চাইলেই একজন আর একজনের মত হতে পারে না। জোর করে অন্য কাউকে অনুসরণ করার চেষ্টা করবেন না, কেননা এতে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়। 

১০) পরিবার, বন্ধু, আত্মীয় এদের সাথে ভালো ব্যাবহার করুন এবং সু সম্পর্ক তৈরি করুন। 

 

পরিশেষে এটা বলতে হয় যে, শারীরিক সুস্বাস্থ্যের মত মানসিক সুস্বাস্থ্যও খুব জরুরী। মানসিক স্বাস্থ্য জনিত সমস্যা আপনার ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে। 

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধি করে, তবে উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। আশে পাশের কেউ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে এমন কেউ থাকলে আমাদের সবারই উচিত তাদেরকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করা।

Default user image

ইকবাল মাহমুদ ইকু, লেখক, আস্থা লাইফ

দীর্ঘদিন ধরেই লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ততার সুবাদে বেশ কিছু স্বনামধন্য অনলাইন পোর্টালে লেখালেখি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই লেখার প্রতি রয়েছে অদম্য অনুরাগ। এই লেখালেখিকেই নেশা এবং পেশা হিসেবে নেয়া আমার ইতোমধ্যেই চারটি উপন্যাস এবং একটি ছোট গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। জন্ম থেকেই ঢাকায় বসবাসরত আমি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেও পথ শিশুদের জীবন যাপনের মান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে আসছি প্রায় ১২ বছর ধরে। বর্তমানে আস্থা লাইফের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে জন সাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছি। বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসি এবং অবসর সময়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর মুভি নিয়েই কাটে।

Related Articles