রাগ কি নিছক আবেগ নাকি মানসিক সমস্যা
রাগ কি শুধুই আবেগ নাকি মানসিক সমস্যা? রাগের পেছনের কালপ্রিটগুলি কারা? রাগ কীভাবে আমাদের অপূরনীয় ক্ষতি করছে? রাগ নিয়ন্ত্রণে করণীয় কি? রাগ সম্পর্কে এই প্রশ্নগুলি জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।

তাড়াহুড়ো করে গোসলের জন্য ওয়াশরুমে ঢুকলো জাভেদ (ছদ্মনাম)। গোসলের একদম শুরুর দিকেই খেয়াল করল সাবান কিংবা শ্যাম্পু নেই এমনকি টাওয়াল টাও আনতে ভুলে গিয়েছে সে। হঠাত রাগে কাঁপতে লাগলো জাভেদ। নিজের রাগ নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে মুষ্টিবদ্ধ হাত দেওয়ালে এতজোরে আঘাত হানল যে সমস্ত হাতের মুষ্টি রক্তাক্ত হয়ে গেল। কিন্তু কেন এমন করল জাভেদ!
আসলে মানুষ তার চিন্তা, চেতনা, বুদ্ধি দ্বারা তৎক্ষনাৎ তার যেকোনো অনুভূতির উপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট আচরণগত প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যা তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ। রাগ, ভয়, করুণা, হিংসা, আনন্দ, দুঃখ, ঘৃণা, বিষ্ময়, উচ্ছ্বাস, হতাশা ইত্যাদি হচ্ছে একেক ধরনের আবেগীয় কার্যকলাপ।
রাগ হচ্ছে এমন একটি আবেগ যখন কোন বিষয় মানুষের অনুভূতিতে আঘাত হানে তখন ব্যক্তি তীব্রভাবে নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে, যা তার বিভিন্ন ধরনের শারিরীক ও মানসিক অপূরনীয় ক্ষতি সাধন করে থাকে। কিন্তু আমরা রেগে যাই কেন?
রাগের পেছনের কালপ্রিটগুলি কারা?
সাধারণত সকল মানুষের মাঝেই মাত্রাভেদে রাগ এর উপস্থিতি পাওয়া যায় যা স্বাভাবিক। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারও কারও মাঝে অতিরিক্ত রাগ পরিলক্ষিত হয়। অনেকেই দ্বিধায় থাকেন যে রাগ বা অতিরিক্ত রাগ একটি মানসিক সমস্যা কি না। রাগ বা অতিরিক্ত রাগ একটি স্বতন্ত্র মানসিক সমস্যা নয়, বরং বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা অতিরিক্ত রাগের বহিঃপ্রকাশের জন্য দায়ী। কিছু উল্লেখযোগ্য মানসিক সমস্যা হল-
-
বাই পোলার ডিসওর্ডার (একই ব্যক্তির মাঝে দু'ধরনের ব্যক্তিত্বের অনবরত সংঘর্ষ)
-
সিজোফ্রেনিয়া
-
এনক্সাইটি ডিসওর্ডার
-
হরমোনাল ইম্ব্যালেন্সড জনিত রোগ
এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, অতিরিক্ত মাদক সেবনের নেতিবাচক প্রভাব, দীর্ঘমেয়াদি শারিরীক অসুস্থতা ইত্যাদি।
রাগ কি শুধুই আবেগ নাকি মানসিক রোগ বুঝবেন কীভাবে?
বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক শারিরীক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া ঘন ঘন প্রকাশ পাওয়া, নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা ইত্যাদি উপসর্গের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায় যে একজন ব্যক্তির মাঝে রাগ বা মানসিক রোগের মাত্রা বৃদ্ধির অবস্থা কতটুকু। বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগের আলাদা আলাদা লক্ষণ রয়েছে। কিন্তু আমরা মানসিক স্বাস্থ্যকে এতটা গুরুত্ব দেই না বিধায় লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আসুন সেগুলি জেনে নেই-
লক্ষণ ও উপসর্গ
-
সকল বিষয় বা ঘটনার নেতিবাচক দিকটি সারাক্ষণ আঁকড়ে ধরে রাখা।
-
সামান্য বা তুচ্ছ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো।
-
কারও ইতিবাচক ব্যবহার বা কাজে বিরক্ত হওয়া।
-
সর্বক্ষণ নেতিবাচক চিন্তায় অস্থিরতা ও অস্বস্তিতে ভোগা।
-
কোন গুরত্বহীন বিষয়কে সহজভাবে নিতে না পারা এবং দীর্ঘসময় পার হওয়ার পরও তা ভুলতে না পারা, ভেতর ভেতর ক্ষোভ জমতে থাকা।
-
শ্বাস নিতে ব্যাঘাত ঘটা,প্যানিক এটাক বা এনজাইটি প্রব্লেম এ বার বার অধিক হারে ভুগতে থাকা, উচ্চ রক্তচাপ সহ বিভিন্ন ধরনের ব্যাথার সম্মুখীন হওয়া।
-
খুবই দ্রুত প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন হওয়া (হয় চুপ থাকা, কিছুক্ষণ বাদেই চিৎকার করা, হঠাৎ প্রচন্ড বিমর্ষ আবার হঠাৎ কর্মক্ষম হওয়া ইত্যাদি)।
রেগে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির কারণগুলি কি কি?
সময়ের সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক ঘটনা,সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সকলের মাঝে নৈতিকতার অভাব ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে আমাদের রাগ দিন দিন বেড়েই চলছে।
পারিপার্শ্বিক
-
পারিবারিক কলহ বা প্রতিনিয়ত অস্থিতিশীল, নেতিবাচক পরিবেশ।
-
বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় ইত্যাদি আপনজনের সাথে ভঙ্গুর সম্পর্ক ও একে অপরের সাথে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর অভাব।
-
দৈনন্দিন কাজ বা কর্মক্ষেত্রে প্রত্যাশিত কর্মফল, সফলতা না আসা।
-
যোগ্যতা অনুযায়ী সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়া।
-
চলমান পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে না পারা, ইত্যাদি।
সামাজিক
-
সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের দূর্নীতি।
-
সামাজিক ভাবে গোড়ামী, অন্যায়, অনৈতিক কর্মকান্ড কে প্রশ্রয় দেওয়া।
-
সামাজিক রেপুটেশন এর নামে ভিত্তিহীন, সামঞ্জস্যহীন মানদণ্ড দাড় করানো।
-
সফলতা অর্জনের ছলে একে অন্যের প্রতি অসুস্থ প্রতিযোগিতা, হিংসা, অহংকার চর্চা করা।
-
অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারা, ইত্যাদি।
এসব নেতিবাচক ঘটনাগুলোর ফকে আমাদের ভেতর রাগের পরিমাণ বেড়ে চলে,যার বিরূপ প্রভাব আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রকাশ করে থাকি।
নৈতিক অবক্ষয়
-
অভাব, অর্থলোভ ইত্যাদির ফলে নৈতিকতা বিবর্জিত কাজে অংশগ্রহণ, মানসিক শান্তি হ্রাস পায় ও তুচ্ছ ব্যাপারেও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজের প্রতি আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।
-
হত্যা, গুম, ধর্ষন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ইত্যাদি অনৈতিক কর্মকাণ্ড রোধের বদলে বেড়ে চলা,অপরাধ করার পরিবেশ সরঞ্জাম ইত্যাদির সহজলভ্যতা রাগ বৃদ্ধির কারণ।
-
ধৈর্য্য, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস, নড়বড়ে ধর্মীয় বিশ্বাস, অপরাধের বা পরিস্থির গভীরতা অনুভব করতে না পারা, নিজের ভুল, অন্যায় উপলব্ধি করতে না পারা ইত্যাদি ও রাগ বৃদ্ধির কারণ।
-
মানুষ তার নীতি নৈতিকতা হারিয়ে ফেললে,তার আকাঙ্ক্ষিত জিনিস অর্জন যদি হয় অন্যায় তবুও সে তা পাওয়ার জন্য যে কোন ধরনের হিংস্রতা প্রকাশেও পিছপা হয় না, এবং ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
রাগ যখন হয় অপূরনীয় ক্ষতির কারণ
রাগ স্বাভাবিক আবেগীয় বৈশিষ্ট্য হলেও তা মোটেও ভাল ফলাফল বয়ে আনে না, রাগের ফলে আমাদের মানসিক,শারীরিক,পারিবারিক সকল জীবন স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শারিরীক
-
উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ সৃষ্টি হয়।
-
হার্ট এটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি।
-
মাইগ্রেন এর সমস্যা বৃদ্ধি।
-
খাদ্যে অরুচি,হজমে বিঘ্নতা।
-
ইনসোমনিয়া বা নিদ্রাহীনতা।
-
মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা,সমস্যা সমাধান সক্ষমতা হ্রাস পাওয়া,স্নায়ু ড্যামেজ হয়ে যাওয়া,টিস্যু ছিঁড়ে যাওয়া।
-
নাবাবিধ চর্মরোগ(ব্রন,একজিমা ইত্যাদি),এসিডিটি বৃদ্ধি, শরীরের বিবিন্ন জয়েন্টে কারণ ছাড়া ব্যাথা অনুভব হওয়া।
-
স্থূলতা সমস্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি।
পারিবারিক
-
পারিবারিক সদস্যদের সাথে বন্ধন দূর্বল হয়ে যাওয়া।
-
সকলের কাছে মূল্য বা গুরুত্ব কমে যাওয়া।
-
ব্যক্তিত্ব হ্রাস পাওয়া।
-
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য,সাপোর্ট না পাওয়া।
-
একাকিত্বে ভুগতে থাকা,ইত্যাদি।
রাগ নিয়ন্ত্রণে করণীয়
-
রেগে যাওয়ার পরিস্থিতিতে ৩ সেকেন্ড কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া না করা।
-
চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রেখে মুখ দিয়ে ছাড়া।
-
তর্ক না করে সরে আসা, এড়িয়ে যাওয়া, গুরত্ব না দেওয়া।
-
হাঁটাচলা করা বা জগিং এর স্পিডে দৌড়ানো।
-
নিয়মিত ব্যায়াম করা।
-
অন্য কোন ব্যস্ততা দিয়ে রাগের বিষয় থেকে মনোযোগ সরানো (গান শোনা, সমস্ত রাগ অনুভূতি এক কাগজে লিখে ফেলা ইত্যাদি)।
-
কলম দিয়ে অনবরত ফুটো করতে থাকা।
-
উলটো গণনা করা (১০০-১)।
-
নিবিড় শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশের কাছাকাছি যাওয়া।
-
হাতমুখ ধোয়া,সম্ভব হলে গোসল করা,মেডিটেশন করা।
-
নিজের সাথে সমোঝতায় আসা।
-
বাগান করা,গাছের পরিচর্যা করা,ছবি আঁকা,শখ প্রাধান্য দেওয়া।
-
ধর্মীয় নীতি মেনে চলা।
-
রাগ কমানীর জন্য নির্দিষ্ট কোন শব্দ বা বাক্য অনবরত বলতে থাকা,ইত্যাদি।
রাগ বিষয়টি খুবই সামান্য মনে হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর প্রভাব খুবই ভয়াবহ। শুধু ব্যক্তি জীবন নয়,সামাজিক,পারিবারিক,রাষ্ট্রীয় জীবন ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। রাগ একটি স্বাভাবিক আবেগিক ক্রিয়া কিন্তু রাগ কোন মানসিক রোগ নয়,তবে মানসিক রোগের এক অন্যতম লক্ষণ। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আমাদের নিজেদের উপর আত্মনিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরী।