ইউস্ট্রেস বনাম ডিস্ট্রেস: যখন আপনার স্ট্রেস আসলেই আপনাকে ভাল করতে পারে

সমস্ত স্ট্রেস বা চাপ আপনাকে একই রকম প্রভাবিত করবে না। ভাল চাপ (ইউস্ট্রেস) আপনার উন্নতিকে ত্বরান্বিত করবে, অপরদিকে যন্ত্রণাদায়ক চাপ (ডিস্ট্রেস) আপনাকে দুর্বিষহ করে তুলবে।

বর্তমান সময়ে একটি পরিচিত শব্দ হল স্ট্রেস (Stress) বা চাপ। কাজের চাপ থাকে না এমন মানুষ খুজে পাওয়া কঠিন। কাজের সাধারণ চাপকেই এখন হরহামেশা স্ট্রেস বলে চালানো হয়। কিন্তু স্ট্রেস কথাটি সাধারণত নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার হয়। সাধারণ কাজের চাপ এবং স্ট্রেস এক নয়। কাজের সাধারণ চাপ যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন তা স্ট্রেস। স্ট্রেস নিয়ে গবেষণায় যে বিজ্ঞানীকে পথিকৃৎ মানা যেতে পারে সেই বিজ্ঞানী (Hans Selye) স্ট্রেসকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। ইউস্ট্রেস (Eustress) এবং ডিস্ট্রেস (Distress)।

ইউস্ট্রেস ও ডিস্ট্রেস শব্দ দুইটি দ্বারা মানসিক চাপ বুঝালেও মানসিক চাপের দুইটি বিপরীত দিককে ইঙ্গিত করে। ইউস্ট্রেসের মাধ্যমে ভালো দিক অর্থাৎ ইতিবাচক দিক বোঝায় আর ডিস্ট্রেসের মাধ্যমে মানসিক চাপের নেতিবাচক দিক প্রকাশ করে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই দুইটিরই কম বেশি প্রভাব রয়েছে। চাপ মানেই ক্ষতিকারক নয়। চাপের মাধ্যমে আপনি আপনার শরীর ও মন কে কঠিন কাজের জন্য অনেকটা প্রস্তুত করে নিতে পারবেন।  মানসিক চাপের এই দুইটি দিক নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।

ইউস্ট্রেস আসলে কি?

আমাদের মানসিক চাপের একটি ইতিবাচক প্রক্রিয়া ইউস্ট্রেস যা আমদের যেকোন কাজের প্রতি মনস্তাত্তিক উত্তেজনাকে বৃদ্ধি করতে পারে কিংবা কোন জটিল কাজ চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মাধ্যমে তা কাটিয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করতে পারে। এতে আমাদের মনের উপর এমন উপকারি প্রভাব ফেলে যা উচ্চস্তরের কর্মক্ষমতাকে সহজ করে দেয়। উত্তেজনার সর্বোত্তম স্তরে পৌঁছতে সহায়তা করে। পরবর্তী কোন কাজের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দিতে পারে। সফলতা, জয়লাভের আনন্দ, পরিপূর্ণতা, কোন নতুন অভিজ্ঞতা এই মানসিক চাপের মূল মন্ত্র। 

ইতিবাচক মানসিক চাপ তথা ইউস্ট্রেসের উদাহরণ কিছুটা এমন হতে পারে-

  • ব্যক্তিগত সফলতা

  • নতুন দক্ষতা অর্জন

  • নতুন কোন ডিগ্রি অর্জন

  • নেটওয়ার্কিং বা মানুষের সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করা

  • নতুন বন্ধুত্ব গড়া

  • নতুন কোন পরিবেশে অভিযোজন ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম  হওয়া

  • নির্দিষ্ট কোন লক্ষে পৌঁছানো

  • আত্মবিশ্বাস অর্জন

  • চাকরির প্রমোশন

  • বিয়ের পরিকল্পনা

  • কোন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ

  • বারি- গাড়ি কেনা

 

ডিস্ট্রেস কী?

মানসিক চাপের ক্ষেত্রে ডিস্ট্রেস হচ্ছে ইউস্ট্রেসের বিপরীত। অর্থাৎ নেতিবাচক মানসিক চাপকে ডিস্ট্রেস বলে। আমরা স্বাভাবিকভাবে মানসিক চাপকেই ডিস্ট্রেস বুঝি। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশের মাধ্যমে মানসিক যন্ত্রণাই ডিস্ট্রেস। এছাড়াও যেকোন বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অক্ষমতা থেকেও ডিস্ট্রেসের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

ডিস্ট্রেসের উদাহরণ এমন হতে পারে-

  • কোন বিষয় নিয়ে উদ্বেগ

  • দক্ষতার বাইরে কোন কাজে অংশগ্রহণ

  • কর্মক্ষমতা হ্রাস

  • মানসিক বা শারীরিক অসুস্থতা

  • অপ্রীতিকর কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা

  • খাপ খাওয়াতে না পারা

  • পারিবারিক বিবাদ

  • স্বজনের মৃত্যু

  • বিবাহ বিচ্ছেদ

  • কর্মজীবনে ব্যর্থতা

ইউস্ট্রেস আপনাকে কিভাবে উপকার করে?

ইউস্ট্রেস আপনার জন্য ভাল দিক কারণ আপনি যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন তা অনুপ্রাণিত করে এই ইউস্ট্রেস। আপনাকে পরিপূর্ণতা, মানসিক সুস্থতা ও আত্মবিশ্বাসী করে দিবে ইউস্ট্রেস। আপনি আপনার শেখার সহজাত ক্ষমতাকে ছোট ছোট জয়ের মাধ্যমে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। জীবনের গতি সচল রাখতে ইউস্ট্রেস তীব্রভাবে কার্যকরী।

ডিস্ট্রেসের ক্ষতিকারক দিকগুলি

ডিস্ট্রেস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাল নয়। যেমন, প্রচণ্ড মানসিক চাপ অনেক সময় আমাদের কর্মক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কাজ করার উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলতে পারি। তাই মানসিক চাপের এটা একটা জঘন্য রুপ। এটি ব্যক্তিগত অস্থিরতা আনে, পেশাগত ঝামেলায় ও দুশ্চিন্তায় ফেলতে পারে। অনেক সময় আপনি ভিতরে ভিতরে ভয় পেতে পারেন বা পুষ্টির অভাবে অথবা ঘুমের স্বল্পতার কারণে নানা ধরণের মানসিক চাপ আপনার মনের মধ্যে হানা দিতে পারে।

অতিরিক্ত প্রেশারের ফলে মানসিক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরতে পারেন। সহজেই রেগে যেতে পারেন বা মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেতে পারে। ঘুম না হতে পারে বা কমে যেতে পারে। খিদে কমে যেতে পারে। এমনকি বিভিন্ন কাজে ভুল হওয়া, নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলা এবং অল্পতেই ক্লান্ত লাগা ও গ্রন্থিতে ব্যথা অনুভবের মত জটিল সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে স্ট্রেসের সম্পর্ক

আমরা অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভাবি না বা চিন্তাও করি না। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়া খুবই জরুরী। কারণ ইউস্ট্রেস বা ডিস্ট্রেস দুই ধরণের চাপই মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। হাজারও রকমের মানসিক চাপ যখন আমাদের মনের মধ্যে বাসা বাধে, আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় বা আমরা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি তখন আমরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরি। মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়।

মানসিক সুস্থতার জন্য ইউস্ট্রেসের ভূমিকা অপরিসীম। ঘুম, অনুভূতি, ব্যথা বা আনন্দের মত স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো মানসিকভাবে সুস্থ থাকার অন্যতম কারণ। ইউস্ট্রেসই পারে এই প্রক্রিয়াগুলোকে সতেজ ও স্বাভাবিক রাখতে। পরবর্তী কাজে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি করতে পারে।

ডিস্ট্রেসকে ইউস্ট্রেসে রূপান্তর করা যায় কি?

মানসিক চাপ ইতিবাচক হোক কিংবা নেতিবাচক, এটাকে আমাদের ভাল দিকে নিয়ে যাওয়া উচিত। ডিস্ট্রেস কে ইউস্ট্রেসে রূপান্তর করা উচিত। হ্যাঁ, এটা অবশ্যই সম্ভব। দৈনন্দিন জীবনে স্ট্রেসের প্রয়োজন রয়েছে। এর উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে কঠিন কাজ মোকাবিলা করা সম্ভব। ডিস্ট্রেস আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু আমরা যখন কার্যতৎপর হয়ে ডিস্ট্রেস কে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারব তখনই সেটা ইউস্ট্রেসে রুপ নিতে পারে। ডিস্ট্রেস যখন আমাদের ঘিরে ধরবে তখন স্ট্রেসকে সমৃদ্ধ করে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। 

প্রচলিত একটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে- “জীবন পুষ্পশয্যা নয়”। জীবনের কঠিন পথগুলো আমাদের যেভাবে হোক পাড়ি দিতেই হয়। আমাদের জীবনে এমন অনেক অভিজ্ঞতা আছে বা থাকবে যা কিনা সবসময় আমাদের জন্য সহজ হবে না। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। ডিস্ট্রেস কে ডিস্ট্রেস বলে সম্বোধন না করে এক প্রকার মানসিক চাপ মেনে নিয়ে কাজের মাধ্যমে আমরা একে ইউস্ট্রেসে রূপ দিতে পারি। তাই ভয় পাওয়ার কারণ নেই, লক্ষ্য অটুট থাকতে হবে, জীবনে কঠিন পরিস্থিতি আসবেই। আর ডিস্ট্রেস কে ইউস্ট্রেসে রুপান্তর করে কর্মক্ষেত্রে সফল হতে হবে।

স্ট্রেস কমিয়ে যেভাবে চাপমুক্ত থাকবেন

স্ট্রেস কমানোর জন্য আপনারা কিছু উপায় অবলম্বন করতে পারেন। যেমন-

  • ঘুম মানুষের ক্লান্তি দূর করে। এটি একটি শারীরিক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একজন মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। পরিমাণ মত ঘুম হলে স্ট্রেস কে নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হয়। এটি খুব সহজ উপায়।                   

  • কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়ামের মাধ্যমে ঘাম ঝরানো শরীরের জন্য উপকারী। এতে মানুষের কর্ম ক্ষমতা বৃদ্ধি হয় এবং শরীরে শক্তি উৎপাদিত হয়। কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে চাপ অনেক কমে যায়।

  • খাবারের পরিমাণ ও গুণগত মান ঠিক রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, খাবারে যেন পুষ্টিমান সঠিকভাবে বজায় থাকে। মাদকদ্রব্য থেকে দূরে থাকতে হবে।

  • মানসিক চাপ কমাতে কায়িক পরিশ্রমের পাশাপাশি খেলাধুলা এবং ভ্রমণ করা যেতে পারে।

  • যেকোন জিনিস নিয়ে ভাল সময় কাটানো যেতে পারে, যেমন বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা, পরিবারের সাথে সময় কাটানো, নিজ ধর্ম অনুশীলন করা, মানুষকে উপকার করা, বাগান পরিচর্যা করা, গাছ লাগানো ইত্যাদি। 

  • সোশাল মিডিয়া যতটা পারেন পরিহার করুন। অনেক সময় আমরা সোশাল মিডিয়াকে স্ট্রেস কমানোর উপায় মনে করি। তবে এটা অনেক সময় স্ট্রেস বাড়ার কারণও হতে পারে। 

  • মানসিক সুস্থতা আপনার নিজের কন্ট্রোলে না থাকলে বা অতিরিক্ত চাপের প্রভাবে অসুস্থ হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

 

জীবনের গতি না থাকলে সাফল্যের সাথে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। আর গতি মানেই চাপ বা মানসিক চাপ। এটা স্বাভাবিকভাবে আসবেই। মানসিক চাপ ভালো হোক বা খারাপ, আপনাকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে যদি আপনি তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আর তাতেই আসবে সাফল্য।  আপনার স্ট্রেসকে ডানা মেলে উড়ে যেতে দিন।

Default user image

খন্দকার মোঃ শওকত হোসেন, লেখক, আস্থা লাইফ

বরিশাল এর নিভৃত ও মনোরম একটি গ্রামে জন্ম। সাহিত্য অনুরাগী মা-বাবার কাছেই লেখালেখির হাতেখড়ি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করলেও লেখালেখির দিকেই ঝোঁকটা বেশি। তাই অবসরে লেখালেখির চেষ্টা করি। লেখনীর মাধ্যমে যদি কারো উপকার করা যায় কিংবা কোন পরিবর্তনের সূচনা করা যায়, তাহলে তৃপ্তিটা আসে মন থেকে। এই উদ্দেশেই আস্থা লাইফ পরিবারে যোগ দেয়া। আমার লেখার মাধ্যমে কারো মধ্যে কিঞ্চিৎ সচেনতাও যদি সৃষ্টি করতে পারি, সেইটাই হবে পরম পাওয়া।

Related Articles